ঢাকা,বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ

চকরিয়ায় সংখ্যালঘু নির্যাতনকারীকে নৌকা প্রতীক না দেওয়ায় খুশি এলাকার মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক :: চতুর্থ ধাপে আগামী ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বাকী আটটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্র থেকে। দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত প্রার্থী তালিকায় ঘোষিত নৌকার মাঝিদের মধ্যে ছয়জন একেবারে নতুন মুখ নৌকা প্রতীক পেয়েছেন। বাকী দুই ইউনিয়নে পুরোনোতে আস্থা রেখেছে দলটি।

আট ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক যারা পেয়েছেন তারা হলেন, বরইতলী ইউনিয়নে জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া, সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম, একেবারে নতুন মুখ ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে উপজেলা যুবলীগ নেতা হেলাল উদ্দিন, হারবাংয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহরাজ উদ্দিন মিরাজ, বমু বিলছড়িতে শহীদ আবদুল হামিদের ছোট ভাই মনজুরুল কাদের, চিরিঙ্গা ইউনিয়নে শাহনেওয়াজ, ডুলাহাজারা ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহনেওয়াজ তালুকদার, খুটাখালীতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আজাদ।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্র থেকে দলের নৌকার প্রার্থী তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। এই ইউনিয়নে নতুন মুখ হিসেবে যুবলীগ নেতা হেলালকে নৌকার প্রার্থী করায় পুরো ফাঁসিয়াখালীসহ পুরো উপজেলাজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে সাধারণ মানুষের মাঝে। কারণ বিগত ২০ বছর ধরে একটি শক্তিশালী অপশক্তির হাতে অনেকটা জিম্মি ছিল ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মানুষ। অবশেষে সেই অপশক্তির কবল থেকে ফাঁসিয়াখালীর মানুষ মুক্ত হতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন তারা।

তৃণমূলের ত্যাগী যুবলীগ নেতা হেলাল উদ্দিনকে নৌকা প্রতীক দেওয়ায় ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন বুধবার বিকেলে। এ সময় তারা নৌকা নৌকা শ্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তুলে।

এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে কেন ছিঁটকে পড়লেন গিয়াস? এমন প্রশ্নে ফাঁসিয়াখালীর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে দলের প্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতন, শিক্ষক নারায়ণ হত্যাকাণ্ডে মদদ দেওয়া, তাদের পৈতৃক সম্পত্তি দখল করা, পুরো পরিবারকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা, পরিবেশ ধ্বংস, সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও উচিতার বিলের বন্য হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপন, বন উজাড়ের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ থাকাসহ নানা অভিযোগের কারণে এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েছেন গিয়াস উদ্দিন। এবার তাকে দলের মনোনয়ন না দেওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগসহ ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ বেশ খুশি।

সংখ্যালঘু নির্যাতনে অভিযুক্ত গিয়াস উদ্দিনকে এবার দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ায় খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন ফাঁসিয়াখালীর দিগরপানখালীসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার হিন্দু সম্প্রদায়। অনেক পরিবারে মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে গিয়াসকে মনোনয়ন না দেওয়ায়।

শিক্ষক নারায়ণের পরিবারকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা, গিয়াসের কবল থেকে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের দাবি ঃ দাবি উঠেছে, নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার দিগরপানখালী গ্রামের শিক্ষক নারায়ণ দাশ হত্যাকাণ্ডের নতুন করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা, গিয়াস ও তার নিকটাত্মীয়দের দখল থেকে নারায়ণদের পৈতৃক সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, দেশান্তরিত হওয়া পুরো পরিবারকে ভারত থেকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনাসহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তদন্ত দল দ্বারা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া।

এই বিষয়ে শিক্ষক নারায়ণের বোনজামাই শিক্ষক রূপন কান্তি দে বলেন, ‘নারায়ণ হত্যাকাণ্ডের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাইসহ তাঁর লোকজন প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছিলেন বাদীকে। পরিবারের সদস্যদের নারায়ণের মতো একই পরিণতি ভোগ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এই অবস্থায় আমার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, মামলার বাদীসহ (শ্যালক) পরিবারের সদস্যরা প্রাণ রার্থে ভিটাবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।’

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চকরিয়ার সভাপতি রতন বরণ দাশ বলেন, ‘শিক্ষক নারায়ণ দের পৈতৃক সম্পত্তি জবর-দখলে রাখেন গিয়াসের ভাই-স্বজনেরা। বিয়ের ১০ দিন আগে নারায়ণকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মামলার বাদী, তাঁর মা-বাবাসহ পরিবার সদস্যদের হুমকি দেওয়া চলতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে শিক্ষক নারায়ণের বৃদ্ধ বাবা-মা, মামলার বাদী ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের স্বদেশে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসের দখল থেকে সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি দলীয়ভাবে তদন্তপূর্বক নারায়ণ হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা গিয়াসসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

গিয়াস কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার আরেক ভুক্তভোগী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ কক্সবাজার জেলার সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর লক্ষ্মণ কান্তি দাশ। ফাঁসিয়াখালীল ঘুনিয়া মৌজায় তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে রাখতে তাঁকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসী দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাঁকে। এ সময় তাঁর প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের এক্সকাভেটর পেট্রল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি দিগরপানখালী গ্রামে লক্ষ্মণের পৈতৃক বাড়ির চারদিকের মাটি কেটে পুকুর খনন করেন গিয়াস। এ ঘটনায় গিয়াসের বিরুদ্ধে তৎসময়ে থানায় মামলা করতে পারেননি লক্ষ্মণ কান্তি দাশ । এর পর আদালতে গিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা করলেও সেই মামলা গতি পায়নি গিয়াসের প্রভাবের কারণে।

নির্যাতিত লক্ষ্মণ কান্তি দাশ বলেন, ‘এবার যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গিয়াসকে মনোনয়ন দেয়নি, সেহেতু আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। একযুগেরও বেশিসময় ধরে পুরো ফাঁসিয়াখালীর মানুষের বুকের ওপর চেপে থাকা জগদ্ধল পাথর সরে গেছে দলের প্রধানের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে। আমিসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন গিয়াস চালিয়েছে এসব ঘটনার প্রত্যেকটির বিচার চাই আমরা। আমাদের বিশ্বাস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মুখে হাসি ফোটাবেন। আমরা স্বাধীন দেশে পরাধীনের মতো আর বাঁচতে চাই না, বুক ফুলিয়ে চলতে-ফিরতে চাই।’

পাঠকের মতামত: